বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৫২ অপরাহ্ন
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: মধ্যস্থকারী হিসেবে কাজ করার আশ্বাস দিলেও ঠিকই শেষ পর্যন্ত মিয়ানমারের পাশেই দাড়ালো চীন। রোহিঙ্গাসহ মিয়ানমারে সংখ্যালঘুদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন-নিপীড়নের আন্তর্জাতিক তদন্ত ও বিচারের আহ্বানসংবলিত প্রস্তাবকে একপেশে বলে অভিহিত করে এ নিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার মানবাধিকার পরিষদে ভোটাভুটির আহ্বান জানিয়েছিল চীন। একই সঙ্গে চীন ও মিয়ানমার সবাইকে প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। ভোটের শেষে ফলে দেখা গেছে, চীন ও ফিলিপাইন ছাড়া কেউই ওই প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়নি। ভারত, জাপান, নেপাল, কঙ্গো, ক্যামেরুন, অ্যাঙ্গোলা ও ইউক্রেন—এই সাতটি দেশ ‘অ্যাবস্টেইন’ ভোট দিয়ে কারো পক্ষ নেওয়া থেকে বিরত থাকে। প্রস্তাবটি গৃহীত হয়েছে ৩৭-২ ভোটে।
► মানবাধিকার পরিষদে বাংলাদেশের উদ্যোগে ইইউ ও ওআইসির যৌথ প্রস্তাব ৩৭-২ ভোটে গৃহীত
► রোহিঙ্গা নিপীড়নের বিচার ও রাষ্ট্রহীনতা দূর করতে হবে, মিয়ানমারকে প্রত্যাবাসন চুক্তি বাস্তবায়নের তাগিদ
ভোটের হিসাবে দেখা যায়, ৪৭ সদস্যের মানবাধিকার পরিষদে গতকাল মিয়ানমার ইস্যুতে ভোট দেয়নি কিউবা। জানা গেছে, কিউবার প্রতিনিধিরা ভোটের সময় অধিবেশন কক্ষে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তাঁরা দৃশ্যত প্রস্তাবটির পক্ষে অবস্থান নিয়ে ভোট দেওয়া থেকেই বিরত থেকেছেন। সাধারণত কিউবা সুনির্দিষ্ট কোনো দেশভিত্তিক প্রস্তাবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে থাকে।
২০১৭ সালের আগস্ট মাসে নতুন করে রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রস্তাব নিয়ে ভোটাভুটিতে মিয়ানমারের পক্ষে এবারই সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের সমান্তরাল নীতিতে চলা রাশিয়া বর্তমানে মানবাধিকার পরিষদের সদস্য নয়। প্রস্তাবসম্পর্কিত দেশ হিসেবে মিয়ানমার মানবাধিকার পরিষদে প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বক্তব্য দিলেও সদস্য না হওয়ায় ভোট দিতে পারেনি।
বাংলাদেশের উদ্যোগে ‘মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমান ও অন্য সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ বিষয়ে এবারের প্রস্তাবটি এনেছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি)। গৃহীত প্রস্তাবে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর যৌন অপরাধসহ সব ধরনের অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মানবাধিকার লঙ্ঘনসংশ্লিষ্ট সব আন্তর্জাতিক বিধান ও আন্তর্জাতিক বিচারপ্রক্রিয়া তথা জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার আওতায় আনার জন্য তদন্তপ্রক্রিয়া জোরদার করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রকারান্তরে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে (আইসিসি) চলমান প্রক্রিয়ার পাশাপাশি ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসের (আইসিজে) শরণাপন্ন হওয়ার উদ্যোগকে আন্তর্জাতিক পরিসরে উৎসাহিত করা হয়েছে।
এ ছাড়া মিয়ানমারবিষয়ক ‘নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক তথ্যানুসন্ধানী মিশনের’ প্রতিবেদনগুলো জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এবং সাধারণ পরিষদের মাধ্যমে জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট সব অঙ্গ-সংগঠনের বিবেচনার্থে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রস্তাবটিতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চলমান সব প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানিয়ে এরূপ পরিস্থিতিতে করণীয় নির্ধারণে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এখতিয়ারের কথা পুনর্ব্যক্ত করা হয়।
জেনেভায় জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মো. শামীম আহসান গতকাল সন্ধ্যায় ভোটের আগে মানবাধিকার পরিষদকে বলেন, মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্মম নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত খুলে দিয়েছিলেন। তবে, দুই বছর পেরিয়ে গেলেও মিয়ানমার এখনো উত্তর রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে।
গৃহীত প্রস্তাবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পাদিত দ্বিপক্ষীয় চুক্তি অনুযায়ী উত্তর রাখাইন অঞ্চলে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে পূর্ণ নিরাপত্তা ও সম্মানের সঙ্গে নিজেদের আবাসস্থলে ফিরে যেতে উৎসাহিত করতে মানবাধিকার পরিষদ মিয়ানমারকে আহ্বান জানিয়েছে। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রশংসা করে প্রস্তাবে রোহিঙ্গারা ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত তাদের গুরুভার বহনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদার হওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়কে আহ্বান জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি বলেন, অবর্ণনীয় নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর পক্ষে জবাবদিহি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার পথে এই প্রস্তাব একটি মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হবে।
ভোটের আগেই মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেন, মিয়ানমার তার অভ্যন্তরীণ বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে অপরাধের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে সক্ষম। প্রস্তাবে কেবল একটি সম্প্রদায়ের মনোভাব প্রতিফলিত হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
চীনা প্রতিনিধিও প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেন, গত সপ্তাহে নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীনের মধ্যে মন্ত্রিপর্যায়ের বৈঠকসহ সাম্প্রতিক সময়ে যে ইতিবাচক অগ্রগতি হয়েছে সেগুলো তুলে ধরতে এই প্রস্তাব ব্যর্থ হয়েছে।
ফিলিপাইনের প্রতিনিধি প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার কথা বলে এই সংকটের মূল কারণগুলো সমাধানের ওপর জোর দেন। জাপানের প্রতিনিধি মিয়ানমারে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানান।